থাইরয়েড লক্ষণ কি ? থাইরয়েড কমানোর উপায় জেনে নিন

আপনি কি জানেন থাইরয়েড কমানোর উপায় গুলো কি?  এর আগে আপনার জানতে হবে থাইরয়েড লক্ষণ কি। কিভাবে বুঝবেন আপনার কিংবা আপনার প্রিয়জনের শরীরে থাইরয়েড সমস্যা আছে কিনা?

ভাবতে পারেন!বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন  মানুষের থাইরয়েড সমস্যা আছে। এটি বিশ্বের জনসংখ্যার আনুমানিক 40%।  আনুমানিক 2·8 হাজার মিলিয়ন মানুষ  আয়োডিনের ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে। এটি এমন পুষ্টি উপাদান  যা থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য৷ তাছাড়া একজন পুরুষের তুলনায় একজন নারীর থাইরয়েড সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা পাঁচ থেকে আট গুন বেশি। তাহলে বুঝতেই পারছেন থাইরয়েড সমস্যা কতটা ভয়াবহ রুপ থারণ করছে। 

এটা এখন খুব সাধারণ প্রশ্ন যে, থাইরয়েড কি ভাল হয়? থাইরয়েডের চিকিৎসা, থাইরয়েড থেকে মুক্তির উপায় অবশ্যই আছে। কিন্তু সবার আগে দরকার থাইরয়েড প্রাথমিক স্টেজ এ শনাক্ত করা। চলুন তাহলে জেনে নিন থাইরয়েড লক্ষণ কি ও থাইরয়েড কামানোর উপায়। 

থাইরয়েড কি?

আপনার থাইরয়েড হল, একটি ছোট, বাটারফ্লাই  আকৃতির গ্রন্থি।  যা আপনার ঘাড়ের সামনের গোড়ায়।অ্যাডাম আপেলের ঠিক নীচে অবস্থিত। থাইরয়েড গ্রন্থি দ্বারা উত্পাদিত হরমোন দুই রকমের হয়। 

  • ট্রাইওডোথাইরোনিন (T3) এবং 
  • থাইরক্সিন (T4) 

এগুলো  আমাদের  স্বাস্থ্যের উপর একটি বিশাল প্রভাব ফেলে। থাইরয়েড গ্রন্থি এমন হরমোন তৈরি করে যা শরীরের বিপাকীয় হার নিয়ন্ত্রণ করে। হৃদপিণ্ড, পেশী এবং হজমের কার্যকারিতায় ভূমিকা রাখে। মস্তিষ্কের বিকাশ এবং হাড়ের রক্ষণাবেক্ষণ করে । এর সঠিক কার্যকারিতা নির্ভর করে খাদ্যে আয়োডিনের পর্যাপ্ত  সরবরাহের উপর। মোট কথা  মানুষের বিপাকের সমস্ত দিককে এটি প্রভাবিত করে।

থাইরয়েড হরমোন কমে গেলে কি হয়?

থাইরয়েড হরমোনের  মাত্রা অনেক কম হবার কারণে মাইক্সেডিমা নামক একটি রোগ সৃষ্টি হয়। এটি আপনার জীবনকে হুমকির সম্মুখীন করতে  পারে। Myxedema হাইপোথাইরয়েডিজমের সবচেয়ে গুরুতর রূপ। myxedema আক্রান্ত একজন ব্যক্তি চেতনা হারাতে পারেন বা কোমায় চলে যেতে পারেন। এই অবস্থার কারণে শরীরের তাপমাত্রা খুব কম হতে পারে।  যা একপর্যায়ে   মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

থাইরয়েড কেন হয়?

থাইরয়েডের সমস্যা নিম্নলিখিত কারণে হতে পারে:

  • আয়োডিনের অভাব।
  • অটোইমিউন রোগ । যেখানে ইমিউন সিস্টেম থাইরয়েডকে আক্রমণ করে।  যার ফলে হাইপারথাইরয়েডিজম হয়। (গ্রেভস রোগের কারণে)।  অথবা হাইপোথাইরয়েডিজম (হাশিমোটো রোগের কারণে)।
  • প্রদাহ (যা ব্যথা হতে পারে বা নাও পারে)।  ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট। 
  • নোডুলস, বা ক্যান্সারযুক্ত পিণ্ড।
  • ক্যান্সার টিউমার।
  • রেডিয়েশন থেরাপি।  থাইরয়েড সার্জারি।  এবং কিছু ওষুধ সহ কিছু চিকিৎসা। 
  • কিছু জেনেটিক ব্যাধি

অনেক সময়ে থাইরয়েড  গ্রন্থিটি বিপাক নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী হরমোন অতিরিক্ত উৎপাদন করে। এই রোগটি বংশগত এবং যে কোন বয়সে পুরুষ বা মহিলাদের মধ্যে  হতে পারে। তবে স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের মতে, 20 থেকে 30 বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে এটি অনেক বেশি সাধারণ। 

থাইরয়েড লক্ষণ কি?

  1. মনোযোগের অভাব 

থাইরয়েড লক্ষণের মধ্যে, মনোযোগ অভাব একদম প্রাথমিক। মস্তিষ্কের কাজ সম্পাদন করার জন্য বিশেষ করে গ্লুকোজ এবং অক্সিজেন প্রয়োজন। যা থাইরয়েড হরমোনে উপস্থিত। ফলে  থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কম হলে মস্তিষ্কের গতি কমে যায়। স্মৃতিশক্তি, কোনো কিছু বোঝা, যুক্তি দেয় এবং প্রব্লেম সলভিং ক্যাপাসিটি কমে যায়।  সহজ কাজ ও  কঠিন করে তোলে।

  1. মহিলাদের পিরিয়ডের সমস্যা 

খুব বেশি বা খুব কম থাইরয়েড হরমোন আপনার পিরিয়ডকে  অনিয়মিত করে তুলতে পারে। থাইরয়েড রোগে আপনার পিরিয়ড কয়েক মাস বা তার বেশি সময়ের জন্য বন্ধ হতে পারে। এই  অবস্থা টি অ্যামেনোরিয়া নামে পরিচিত। যদি আপনার শরীরের থাইরয়েড রোগ বাসা বাধে তাহলে ইমিউন সিস্টেমে ঘাটতি হয়। এবং   আপনার ডিম্বাশয় সহ অন্যান্য গ্রন্থি কে  প্রভাবিত করে। 

  1. অতিরিক্ত চুল পড়া

গুরুতর এবং দীর্ঘায়িত হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপারথাইরয়েডিজম চুলের ক্ষতি করতে পারে। এটি   মাথার ত্বকে ছড়িয়ে পড়ে। এবং চুলের গোড়া কে আলগা করে দেয়। ফলে প্রচুর চুল পরে। এবং রুক্ষ হয়ে যায়। 

  1.  পেশীতে দূর্বলতা

পেশীতে দূর্বলতা ও ব্যথা ল থাইরয়েড লক্ষণগুলির মধ্যে কমন। হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ হিসাবে। পেশী ব্যথা শরীরের প্রতিটি পেশীতেই হতে  পারে। শরীরের পেশীবহুল জায়গা গুলো শক্ত হওয়া, ব্যথা, দুর্বলতা  এগুলোই সাধারণ সমস্যা।  হাইপোথাইরয়েডিজমের 30-80% লোকের ই পেশীতে এসব সিম্পটম দেখা যায়। 

  1. হাড়ে ও জয়েন্ট অস্বাভাবিক যন্ত্রণা 

থাইরয়েড লক্ষণ এর মধ্যে আরেকটি সাধারণ লক্ষণ হল হাড়ে ব্যথা। এই ব্যথা হাড়ের জয়েন্টে জয়েন্টে ছড়িয়ে যেতে পারে। এই অস্বাভাবিক যন্ত্রণা থেকে থাইরয়েড লক্ষণ অনেকটাই শনাক্ত করা যায়।  

  1.  মানসিক অবসাদ 

থাইরয়েড রোগ আপনার মেজাজকে প্রভাবিত করতে পারে ।  প্রাথমিকভাবে উদ্বেগ বা বিষণ্নতা সৃষ্টি করে। সাধারণত, থাইরয়েড রোগ যত বেশি তীব্র হয়, মেজাজের পরিবর্তন তত বেশি হয়।

  1. ক্লান্তি

ক্লান্তি হাইপোথাইরয়েডিজমের একটি  সর্বজনীন লক্ষণ। থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে হ্রাসের ফলে এই  অবস্থা ঘটে। হাড়-অসাড় হয়ে আসা ও  ক্লান্তি খুবই লক্ষণীয় বিষয়।  আপনার থাইরয়েডের মাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত না হলে এরকম সমস্যা দেখা দেয়। 

  1. হঠাৎ ওজন অনেক বেড়ে যাওয়া

ওজন বৃদ্ধি থাইরয়েড হরমোন কমে যাবার সংকেত ।   অন্যদিকে  যদি থাইরয়েড শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হরমোন তৈরি করে।  তাহলে আপনার ওজন  অপ্রত্যাশিতভাবে কমতে পারে। 

থাইরয়েড কমানোর উপায় 

 থাইরয়েড লক্ষণ গুলো জানার পর এবার আসি থাইরয়েড  কমানোর উপায় তে। আপনি যদি যথা সময়ে থাইরয়েড শনাক্ত করতে পারেন।  তাহলে আশা করা যায় থাইরয়েড থেকে মুক্তির উপায় ও পেয়ে যাবেন।   বিভিন্ন ভাবে থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা করা যায়।  সেগুলো হল- 

থাইরয়েড চিকিৎসা

হাইপোথাইয়েডের চিকিৎসা একটি লং টার্ম ট্রিটমেন্ট। ছয়  মাস পর পর  বা একবছর অন্তর  থাইরয়েডের অবস্থা  টেস্ট  করা হয়। নিয়মিত ডোজ গ্রহণ করলে  কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না।  এবং থাইরয়েড নিয়ন্ত্রনে আসে।  হাইপার থাইরয়েডের যাদের আছে তাদের  অ্যান্টি থাইরয়েড মেডিসিন  দিয়ে ট্রিটমেন্ট  করা হয়। ৪০ পার্সেন্ট মানুষের  ক্ষেত্রে ১৮ মাস বা  ২ বছরের মধ্যেই  থাইরয়েড  চিকিৎসা সফল  হয়। বাকিদের ক্ষেত্রে   রেডিও আয়োডিন অপারেশন  বা সার্জারি করাতে হয়। 

আন্ডারঅ্যাক্টিভ থাইরয়েড এর ক্ষেত্রে (হাইপোথাইরয়েডিজম)।  সাধারণত লেভোথাইরক্সিন নামক দৈনিক হরমোন প্রতিস্থাপন ট্যাবলেট গ্রহণের করা হয়।   লেভোথাইরক্সিন থাইরক্সিন হরমোনকে প্রতিস্থাপন করে।  যা আপনার থাইরয়েড  পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। 

থাইরয়েড রোগীর ডায়েট চার্ট 

থাইরয়েড কি খাওয়া বারণ ও থাইরয়েড হলে কি কি খেতে হয় সেগুলো না জানলেই নয়।  এক নজরে দেখে নিন থাইরয়েড রোগীর খাবার তালিকা- 

  • আপেল সিডার ভিনেগার থাইরয়েড কমানোর উপায় হিসেবে খুবই কার্যকরী।

কারণ এটি ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ করে বিপাকে সাহায্য করে।

  • নিয়মিত আদা চা পান করলেও থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণ আসে।  কারণ আদায় থাকে পটাশিয়াম,  ম্যাগনেশিয়াম এর মত খনিজ। 
  • ভিটামিন বি১২ জাতীয় খাবার যেমন,  বাদাম, ডিম, মাংসা, মাছ ইত্যাদি।  হাইপোথাইরয়েডিজম রোগে আক্রান্তদের জন্য এগুলো খুব উপকারী
  • স্যালমন, সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম ইত্যাদি ভিটামিন ডি জাতীয় খাবার থাইরয়েড সমস্যা  কমাতে সাহায্য করে। 
  • আয়োডিন ও মিনারেল আছে এমন খাবারও নিয়মিত খেতে হবে।
  • জাঙ্ক ফুড একেবারেই পরিহার করতে হবে।
  • স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে হবে।

পরিশেষে

আমাদের শরীরে প্রতিটি হরমোনই নির্দিষ্ট পরিমানে থাকা উচিত। এর কম বেশি হলেই দেখা দেয় ছোট বড়  নানা রোগ। কখনও বা দেখা দেয় মরনব্যাধি।  থাইরয়েড সমস্যা একটি হরমোন জনিত রোগ।  যা আপনার শরীরকে দারুন ভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু  সঠিক ভাবে ট্রিটমেন্ট করাতে পারলে থাইরয়েড সমস্যার সমাধান সম্ভব। তাই থাইরয়েড লক্ষণ গুলো সময় থাকতেই শনাক্ত করুন। নিজের  ও   প্রিয়জনের সুস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের দেয়া থাইরয়েড কমানোর উপায় গুলো ফলো করুন।