যুক্তফ্রন্ট কেন গঠিত হয়েছিল ? ব্যাখ্যা সহ জেনে নিন

তৎকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ১৯৫৩ সালের ২৭শে জুলাই কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠন করে। যার নাম সংক্ষেপে কে এস পি। কে এস পি গঠন করা হয় একে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে এবং আব্দুল লতিফ বিশ্বাস সাধারণ সম্পাদক করে।

আবার অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসেম, এই দল থেকে বের হয়ে নতুন একটি দল গঠন করে। যার নাম দেয় খেলা হতে রাব্বানী পার্টি। আবার অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতহার আলী ১৯৫৩ সালের শেষের দিকে নেজামে ইসলাম পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে।

এইসব দলগুলো ছাড়াও আরো ছোট ছোট কতগুলো গণতন্ত্রী দল ছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কংগ্রেস, সোস্যালিস্ট পার্টি, তপশিলি ফেডারেশন ইত্যাদি। কিন্তু সবচেয়ে মজার একটি বিষয় হল যে পাকিস্তান সরকার ১৯৪৮ সালে এদেশে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে। যে কারণে কমিউনিস্ট পার্টি কোন সময়ে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল না।

এরপরে ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসের ১৪ কিংবা ১৫ তারিখের দিকে, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ময়মনসিংহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে কাউন্সিল অধিবেশনে বসে। সেই কাউন্সিলর সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়।

তখন বড় বড় সব ছাত্র সমাজ গুলোর চাপের কারণে যতগুলো বিরোধী দল ছিল সবগুলো একত্র হয়ে প্রথমবারের মতো যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। সে যুক্তফ্রন্ট শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী গঠন করার জন্য মিলিত হয়। তারা তিনজন মিলে ১৯৫৩ সালের ৪ই ডিসেম্বর সবগুলো ছোট ছোট দল এবং বিরোধী দলগুলোকে একত্র করে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে।

এরপরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি আবুল মনসুর আহমেদ ২১ দফা প্রণীত করে। পরবর্তীতে আবুল মনসুর আহমেদ প্রণীত সেই ২১ দফায় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা স্বাক্ষর করে। এরপর ১৯৫৩ সালে ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখে প্রথমবারের মতো ২১ দফা জন সাধারনের সামনে প্রকাশ করা হয়।

এরপরে সেই ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তখন যুক্তফ্রন্টের ভোটের প্রতীক দেওয়া হয় নৌকা মার্কা। অন্যদিকে মুসলিম আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতীক দেওয়া হয় হারিকেন। এরপরে পাকিস্তান সরকারের দেওয়া ১৯৫৪ সালের ৭ই মার্চ থেকে ১২ই মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

সেই নির্বাচনে মোট আসন সংখ্যা ছিল ৩০৯ টির মত। যার মধ্যে ৭২ টি আসন হিন্দু ও তপশিলিদের জন্য বরাদ্দ কৃত ছিল। তৎকালীন সময়ে সেই নির্বাচনে মুসলমানদের আসন সংখ্যা ছিলো ২৩৭ টি এর মত। এছাড়া আর বাদ বাকি নয়টি আসন ছিল যেগুলোতে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করতে পারেনি।

তৎকালীন সময়ে যুক্তফ্রন্ট পূর্ব পাকিস্তানে ভোটের বিপ্লব শুরু করে। যুক্তফ্রন্ট বিপুল পরিমাণ ভোটে জয়লাভ করলে সেইসাথে জয় হয় জাতীয়তাবাদের। এরপরে ১৯৫৪ সালের ২রা এপ্রিল সরকার ভোটের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

যার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচন করে। শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন মুসলিম লীগ প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান ঠান্ডা মিয়া কে পরাজিত করে প্রাদেশিক আইনসভায় এমএলএ পদে নির্বাচিত হয়।

গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমানের এত বড় মানে বিপুল ভোটে জয়লাভ করার পর তিনি বলেন; ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব প্রায় ১০ হাজারের ও বেশি ভোটে পরাজিত হয়েছে। বাংলার জনগন আমাকে শুধু ভোট দিয়েছে তাই নয়, সেই সাথে আমি পাঁচ হাজার টাকার নজরানা হিসেবে পেয়েছিলাম যাতে নির্বাচনের বিভিন্ন খরচ চালাতে পারি।

আমি একটা জিনিস সবসময় ধারণা করি যে, “মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও আমাকে ভালোবাসবে। আমি যদি তাদের জন্য সামান্য ত্যাগ স্বীকার করি তারা আমার জন্য প্রয়োজনে তাদের জীবন ও বিলিয়ে দিতে পারবে।

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যুক্তফ্রন্টের প্রধান নেতা নির্বাচিত হন। একে ফজলুল হক জয়ী হয়ে মন্ত্রী সভা গঠন করে। সেইসাথে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় গঠন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেওয়া শুরু করে। মত বিরোধ দেখা দেওয়ার পরে কিছু ভেবে না পেয়ে একে ফজলুল হক ১৯৫৪ সালের ৩ই এপ্রিলে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে। সেই সাথে সেই বছরই ১৫ই মে পূর্ণাঙ্গ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করে প্রকাশ করে।

নিচে সেই মন্ত্রিসভার বিভিন্ন সদস্যদের উল্লেখ করা হলো;

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়। সংস্থাপন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পথটিও তার কাছে থাকে। আবুল হোসেনকে অর্থ মন্ত্রী করা হয়। আতাউর রহমান খানকে বেসামরিক সরবরাহ পদ দেওয়া হয়। আবুল মনসুর আহমেদ কে গণ স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আইন ও বিচার বিভাগ দেওয়া হয় কফিল উদ্দিন চৌধুরীকে। শিক্ষা ও রেজিস্ট্রেশন খাতের দায়িত্ব পান আজিজুল হক। আব্দুস সালাম খান কে দেওয়া হয় শিল্প পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। সেই সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কৃষি ঋণ ও পল্লী উন্নয়নের মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে স্বাস্থ্য ও কারা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আব্দুল লতিফ বিশ্বাস কে দেওয়া হয় রাজস্ব ও ভূমিসংস্কার বিভাগের দায়িত্ব।  হাসিম উদ্দিন আহমেদকে বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

আশরাফ আলী চৌধুরীকে সড়ক উন্নয়ন পদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইউসুফ আলী চৌধুরী কৃষি পাঠ ও বন বিভাগের দায়িত্ব দেওয়। সেই সাথে মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন হোসেনকে জমিদারি অধিগ্রহণের পথটি দেওয়া হয়।

মন্ত্রিসভায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রে আদমজী জুট মিল-এ দাঙ্গা শুরু হয়। সেই দাঙ্গায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়। আদমজী জুট মিল এর দাঙ্গা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষ্যে জানা যায় তিনি বলেন; 

একটা সামান্য ঘটনা নিয়েই দাঙ্গা শুরু হয়েছে। এই দাঙ্গা যুক্তফ্রন্ট সরকার কে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য করা চক্রান্ত করে করা হয়েছে। দুনিয়াকে নতুন সরকারের অদক্ষতা দেখানোর জন্য বিরাট এক ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।

আর এই ষড়যন্ত্রের করা হয়েছে নির্দিষ্ট মানুষের সাহায্যে তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর  মূলত এই ষড়যন্ত্রে চক্রান্তটি করা হয়েছে করাচি থেকে এতে আমার বিন্দু পরিমান সন্দেহ নেই।

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যখন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন তিনি অনেক গুলো ইসতেহার পালন করতে সক্ষম হয়। তখন তিনি একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস পালন করার সরকারী ছুটি ঘোষনা করে।

সেইসাথে তিনি ভাষা আন্দোলনের সম্মানে শহীদ মিনার নির্মাণ করতে বলেন। এছাড়া তিনি বর্ধমান হাউস কে বাংলা একাডেমিতে রূপান্তর করার জন্য আদেশ দেয়।

যদিও এই সবগুলো আদেশ দেয়া হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় সবার সম্মতিতেই। তবে এই সময় একটি কথা প্রচলিত ছিলো যে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সর্বপ্রথম বলেছিল বাংলা স্বাধীন করাই তার প্রথম কাজ। যার ভিত্তিতে ১৭৯১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। যদিও এই স্বাধীনতা কথাটি সর্বপ্রথম শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু তিনি সেভাবে বলেননি যেভাবে বললে বোঝা যাইত যে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে যখন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বাংলা স্বাধীন হবে তার প্রথম কাজ একথাটি বলে।

তার এই কথাটি ধরে ১৯৫৪ সালের ৩১ই মে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ করে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। সেই সাথে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দিয়ে ৯২ক ধারা জারি করে। ৯২ক ধারা জারি করার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশ তার বাসায় যায়। কিন্তু তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাসায় ছিলেন না। তিনি যখন বাসায় আসেন এবং জানতে পারেন যে তাকে ধরার জন্য পুলিশ তার বাসায় প্রবেশ করেছিল।

তিনি তখন তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াহিয়া খান চৌধুরী কে ফোন করে বলে, আমার বাসায় পুলিশ এসে ছিল হয়তো আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য আর আমি তখন বাসায় ছিলাম না। কিন্তু আমি এখন বাসায় আছি আমাকে এখন গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে পারেন। এরপর পরই তার বাসায় পুলিশ গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে জেলে নিয়ে যায়।

তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দেশের বাইরে ছিল। আর সেইসাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে ছিলো। যার কারনে এর কোনো প্রতিবাদ করা হলো না। এতে করে ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারলো যে বাঙালি যতই চেষ্টা করুক না কেন তারা তাদের জন্য কোন সমস্যাই সৃষ্টি করতে পারবে না।

এই যখন বাঙ্গালীদের অবস্থা তখন তারা ভাবতে লাগলো যে মামলা আর লাঠি দেখলে বাঙালিরা চোরের মত গর্তে ঢুকবে। তখন যদি বাঙালিরা আন্দোলন করে প্রতিবাদ করত। সেই সাথে এই অন্যায়ের জন্য যদি তারা বাধা দিত, তাহলে হয়তো হাজারবার চিন্তাভাবনা করা হতো বাঙ্গালীদের উপর বিভিন্ন অন্যায় অত্যাচার করার জন্য।

কিন্তু তৎকালীন সময়ে যুক্তফ্রন্টের অনেক প্রধান নেতা ছিল যারা বিভিন্ন জায়গা এই মিথ্যে অপবাদের কোনো আন্দোলনই গড়ে তোলেনি।

যুক্তফ্রন্টের এই কাপুরুষতার দেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিল; ওই দিন থেকে আমাদের বাঙ্গালীদের দুঃখের দিন শুরু হয়েছিল অযোগ্য নেতৃত্ব এবং নীতিহীন নেতা সেইসাথে কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোন সময় একসাথে দেশের জন্য কাজ করা যায় না। তাদের সাথে কাজ করতে নেই এতে করে দেশের মানুষের বা দেশের জনগণের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে

এরপরে ১৯৫৩ সালের ২৩শে অক্টোবর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পশ্চিম পাকিস্তানের গণপরিষদ ভেঙে দেন। তারপরে বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। আর অন্যদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিভিন্ন চেষ্টায় মুজিবুর রহমানকে ১৯৫৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর জেল থেকে বের করে আনেন।

তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় সাত মাসের মত সময় বন্দি জীবন যাপন করেছিল। এরপর তিনি তার পরিবারের সাথে দেখা করেন। তখন জানা যায় যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো পরিবার মিন্টু সরকারি বাসভবন টি ছেড়ে অন্য একটি বাসা ভাড়া করে বসবাস করেছিল।

সদ্য জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার দল করাচিতে যেতে বলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন জানতে পারে যে হোসেন সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছে। জানা যায় যে, সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় যোগ দেওয়ার কারণে খুবই রাগ করেছিল।

১৯৫৪ সালে ২১ দফার ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। সেইসময় যুক্তফ্রন্টের প্রতীক দেওয়া হয়েছিল নৌকা মার্কা কে। অন্যদিকে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতীক ছিল হারিকেন। ১৯৫৪ সালের ৭ই মার্চ থেকে ১২ই মার্চ পর্যন্ত সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সাথে যুক্তফ্রন্ট বিপুল পরিমাণ ভোটে জয় লাভ করে।

মোহাম্মদ আলী আইন মন্ত্রী হিসেবে ১৯৫৪ সালের ২৯ই ডিসেম্বর মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়। সেই সাথে তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে দেশ বড় ছিল তাই সে ও মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেছিল। এছাড়া মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তৎকালীন সময়ে ইউরোপ থেকে ফিরে কলকাতার একটি হোটেলে অবস্থান করেছিল। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ ছিল না।

কেননা তৎকালীন সময়ে যুক্তফ্রন্ট একটু একটু করে প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে গোলাম মোহাম্মদ হোসেন সোহরাওয়ার্দীকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করেই, কে এস পি নেতা আবুল হোসেনকে সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়। আবার মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যেন ফিরে না আসতে পারে সেজন্য গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ভাসানীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

পরবর্তী সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিভিন্ন চেষ্টা করার মাধ্যমে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে ১৯৫৫ সালের ২৬শে এপ্রিল কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে। আওয়ামী মুসলিম লীগের সাথে একে ফজলুল হকের সাথে কথা হয়েছিল যে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা মানতে হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা থাকবে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক।

বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে প্রধান মন্ত্রী করা হলে এতে ক্ষুব্ধ হলে আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আতাউর রহমান খান, আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিনজনে মিলে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের উদ্যোগ গ্রহণ।

সেই সাথে দুই দলই নিজেদের কে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে দাবি করে বসে। অবশেষে ফেব্রুয়ারির এক অনুষ্ঠানে পক্ষে এবং বিপক্ষে ভোট গ্রহণ শুরু করা হয়। সেই অনাস্থা প্রস্তাবের ১৯৯ জন এবং একে ফজলুল হক কে সমর্থন করে এবং ১০৫ জন আতাউর রহমান খানকে সমর্থন করে।

অনাস্থা প্রস্তাব পাশ করার পর পরই এই যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেল। তবে এসব যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গার জন্য সবচেয়ে বেশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দায়ী করা হয়। তবে প্রকৃত পক্ষে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল আর কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্রের কারণে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। এরপর ১৯৫৫ সালের ৩শে জুন ৯২নং ধারা  প্রত্যাহার করা হয়। সেই থেকে আবুল সরকার পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়।

এভাবেই সৃষ্টি হয় বাংলা মানুষের রক্ষার জন্য যুক্তফ্রন্টের আবার এভাবেই রাজনৈতিক বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পার করে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। যুক্তফ্রন্টের কারণে বাংলার মানুষ পেয়েছিল সর্বপ্রথম কোন পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।

কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায় আর ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্যায় অত্যাচার ও অধিকার বৈষম্য শুরু হয়।  যদি তখন যুক্তফ্রন্ট না ভেঙে যেতো তাহলে হয়তো পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমতা সেটা আরো অনেক বছর বজায় থাকতো।

শেষ কথা
এই যুক্তফ্রন্টের কারণে আমরা বাঙালিরা পেয়েছিলাম আমদের সমান অধিকার। কিন্তু আবার যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গার কারণে আমরা বাঙালিরা আবার আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করি। বাঙালি হিসেবে বিভিন্নভাবে যুক্তফ্রন্টের কারণেই ১৯৫৪ সালে মাতৃভাষা সহ বিভিন্ন অধিকার আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

এই যুক্তফ্রন্টই ছিল আমাদের প্রথম অধিকার আদায়ের ছোট বড় সব রাজনৈতিক দলের সংগঠন। যার কারণে আমরা বহু ভাবে নিজেদের অধিকার আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলাম। যদি যুক্তফ্রন্ট না ভাঙ্গতো তাহলে হয়তো বাঙালি জাতীর দুঃখের দিন শুরু হত না। বাঙ্গালীদের ও পাকিস্তানীদের মধ্যে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে সেটার শুরুই হয়েছিলো যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গার ফলে।

এক কথায় বলা চলে যে যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গার কারণে আমরা বাঙালিরা লাভবান হয়েছি। সেই সাথে যুক্তফ্রন্ট না ভাঙ্গলেও হয়তো আমরা বাঙালিরা লাভবান ই হতাম। যদি যুক্তফ্রন্ট ভাঙতো তাহলে হয়তো আমাদের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের কথা সমান ভাবে বলতে পারতাম। দুই দেশেরই অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হতো না।

পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান সব সময় সমান অধিকার ভারসাম্য থাকত। কেননা তৎকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানেরচেয়ে বেশি রাজনৈতিক নেতা পূর্ব পাকিস্তানে ছিলো সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানেই সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক আসন সংখ্যা ছিলো। সে তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের খুব কমই এবং অল্প সংখ্যক আসন সংখ্যা ছিল। অন্যদিকে আবার যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গার কারণে আমরা লাভবান হয়েছিলাম। কেননা যদি যুক্তফ্রন্ট যদি না ভাঙ্গতো তাহলে হয়ত আমরা একটি স্বাধীন বাংলাদেশ নামে স্বাধীন এক টুকরো ভূখণ্ড পেতাম না।

তখন হয়তো আমরা পুরো পাকিস্তান কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ ই থাকতাম। যাইহোক এই যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গার কারণে হয়তো আমাদের স্বাধীনতার ডাক পড়েছে। যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গার কারণে আমরা বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হয়েছিলাম। বিভিন্ন অধিকার আদায়ে থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গার পর থেকে আমরা আমাদের বিভিন্ন অধিকার থেকে যে পরিমাণ বঞ্চিত ছিলাম।
সেই অধিকার আদায়ের কারণে আস্তে আস্তে করে আমাদের জাতীয়তা সেগুলো জেগে উঠে। আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করার জন্য একটু একটু করে  এগিয়ে যেতে থাকি।

এভাবে আমরা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়  দেশকে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন করি। সেই সাথে আমরা নতুন প্রজন্ম উপহার পাই বাংলা দেশ নামক একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের।

Updated: April 3, 2022 — 4:47 pm