হ্যালো বন্ধুরা কেমন আছেন সবাই। আজকে আমি আপনাদের সাথে আলোচনা করতে যাচ্ছি ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি এবং এর কারণ সমূহ নিয়ে তো চলুন শুরু করা যাক। ব্রিটিশদের প্রায় দু’হাজার শাসনের পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা আলাদা রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় তো পাকিস্তান রাষ্ট্র দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং অন্যটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তান।
শুরুটা হয় ১৬৬৬ সালের ৭ই জুন পূর্ব পাকিস্তানের ছয় দফা আন্দোলনের পক্ষে একটি সাধারণ ধর্মঘট পালন করা হয়।
ছয় দফা দাবির মূল কারণ হলো পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার না দেওয়া। পশ্চিম পাকিস্তান বছরের পর বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা সুবিধা অনুপাতিক দেয় না। সে কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন চলতে থাকে।
এ রকম বৈষম্য চলতে চলতে এক সময় রহমান সোবহান নুর ইসলাম সহ আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ছয় দফার খসড়া প্রণয়ন করে। যা তাজ উদ্দিন আহমেদ বাস্তবায়ন করতে থাকে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে এক ভাষণে ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করে। এরপরে ৪ই ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের লাহোরে পরেরদিন ৫ই ফেব্রুয়ারি সরকারবিরোধী সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করে।
এরপর এই রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে খবর প্রকাশ করে। এরপরে ছয় দফা দাবি কে ঘিরে তেইশে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি কে আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা বলে আখ্যায়িত করে। মূলত ছয় দফা দাবির কর্মসূচির আসল ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মত। পরবর্তীতে ওই ছয় দফা দাবি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ আন্দোলন বিক্ষোভ সমাবেশ করে। পরবর্তীতে এই ৬ দফা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বা ‘ম্যাগনা কার্টার’ নামে পরিচিত হয়।
ছয় দফা কি?
১৯৬৬ সালের ৫ই ও ৬ই ফেব্রুয়ারি তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে সরকার বিরোধীদলের সম্মেলনে তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন। যেখানে স্বায়ত্তশাসন এর মত ক্ষমতা প্রদান করা সহ মোট ছয়টি দাবি উপস্থাপন করা হয়। যা ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি হিসেবে পরিচিতি।
তবে এই ছয় দফা দাবি পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানে সবার জন্য উপস্থাপন করা হলেও মূলত এই ছয় দফা কর্মসূচিকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে পরবর্তীতে রূপ পায়, পরবর্তীতে এই ছয় দফা দাবি কি বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বলা হয়।
ছয় দফা দাবি কেন উপস্থাপন করা হয়?
ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করার মূল বিষয়গুলো হলো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের বৈষম্যের কারণ।
কেননা তৎকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে বেশি জনসংখ্যা বসবাস করত। পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক সবাই পাকিস্তানের নাগরিক থাকলেও বিভিন্ন চাকরি-বাকরির ও কাজ কর্মের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেশি অগ্রাধিকার পেতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এইসব বিভিন্ন অধিকার বৈষম্যের কারণে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সরকার বিরোধী ভাষণে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেছিল।
এই ছয় দফা দাবির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে একটি সাহিত্য শাসিত প্রদেশ হিসেবে ছিল। যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি শায়ত্ব শাসনের জন্য করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই ছয় দফা দাবি বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনামের কার্টার হিসেবে আস্তে আস্তে রূপ পেতে থাকে। ঐতিহাসিক এই ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
ছয় দফা দাবি গুলো কি কি?
চলুন জেনে নেই ছয় দফা দাবি সমূহ কি কি ও ছয় দফা দাবি সমূহ এর বিস্তারিত। ৬ দফার দাবিসমূহ গুলো হলো নিম্নরুপ
১ম নং প্রস্তাবঃ শাসনতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা
রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও শাসনতন্ত্র কাঠামো লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি কেন্দ্রীয় শাসিত রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। আর দুই পাকিস্তান কে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র হতে বাস্তবায়ন করতে হবে।
দুই পাকিস্তান রাষ্ট্রের মিলে একটি সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রতিটা রাজ্যের প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হিসেবে গণ্য করা হবে।
২য় নং প্রস্তাবঃ কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা
প্রতিটা অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা অঙ্গরাজ্য পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে।
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা থাকবে শুধুমাত্র দেশ রক্ষা করার জন্য ও বিদেশি নীতির জন্য। দেশকে রক্ষা করার জন্য সব ধরনের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে।
আবার বৈদেশিক নীতি বিষয়ক সব কিছু কেন্দ্রীয় সরকার দেখাশোনা করবে।
আর এসব ছাড়া বাকি যেসব বিষয় গুলো থাকবে সেসব বিষয়গুলো শুধুমাত্র অঙ্গরাজ্য গুলো পরিচালনা করে থাকবে।
৩য় নং প্রস্তাবঃ মুদ্রা ও অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা
অর্থ ও মুদ্রা বিষয়ক ক্ষমতার মধ্যে দুটি নিম্নলিখিত প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারে বলে ৬ দফা দাবিতে উপস্থাপন করা হয়।
ক. প্রতিটা দেশের জন্য আলাদা এবং অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে বা চালু থাকবে।
খ. বর্তমানে সারা দেশের জন্য একটি মুদ্রা থাজবে। যেই মুদ্রা দুটি দেশের মধ্যে যেকোন দেশে চলবে।
তবে এক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে একটি অঙ্গরাজ্য থেকে অন্য একটি অঙ্গ রাজ্যের প্রকৃত মূলধন পাচার বন্ধ হয় বা রোধ করা যায়।
এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা ব্যাংকিং রিজার্ভ ও আলাদা আলাদা রাজস্ব গ্রহণ এবং মুদ্রা নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে।
৪র্থ নং প্রস্তাবঃ রাজস্ব, কর, বা শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা
প্রতিটি অঙ্গ রাষ্ট্রের নিজস্ব যে রাজস্ব থাকবে তার একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকার পাবে।
কিন্তু প্রতিটি অঙ্গ রাজ্য তাদের রাজ্যের জন্য আলাদা আলাদা রাজস্ব আদায় করতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকার কে অঙ্গরাজ্য কে আলাদা আলাদা কর আদায় করতে হবে বা শুল্ক আদায় করার নির্দিষ্ট ক্ষমতা দিতে হবে।
আবার কেন্দ্রীয় সরকার ঠিকই অঙ্গরাজ্য থেকে রাজস্ব আদায়ের একটি অংশ পাবে।
৫ম নং প্রস্তাবঃ বৈদেশিক বানিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা
বিদেশের বাণিজ্য বিষয়ক সব রকমের ক্ষমতা ছাড়ার আওতায় থাকবে এবং প্রতিটি রাজ্য বহির্বাণিজ্যের আলাদা আলাদা হিসাব রাখবে।
আসলে পাঁচ নং প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে প্রতিটা রাজ্য বিদেশে যে সব পণ্য আমদানি রফতানি বাণিজ্য বিষয়ক যা যা রয়েছে সবকিছু অঙ্গ রাজ্য গুলো আলাদা আলাদা হিসেব-নিকেশ করবে।
কিন্তু এর মোট হিসেবটা ঠিক এই ফেডারেল সরকারের কাছে থাকবে।
মানে বিদেশ থেকে একটি অঙ্গরাজ্য যেই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে সেই বৈদেশিক মুদ্রা একটি দেশের কাছে থাকবে। এই দেশ থেকে অন্য দেশে পাচার করা যাবে না।
সেইসাথে বৈদেশিক যে ঋন থাকবে সেই সব দেশ যে যতটুকু পরিমাণ ঋণ করবে সেই নিজে একাই ততটুকু পরিমাণ ঋণ শোধ করবে।
এছাড়াও এই দুটি দেশকে আলাদা আলাদা কোনো রকমের বাণিজ্য দেশের উৎপাদন দেশের জাতীয় কোন ধরনের নিয়ম নীতি থাকবে না।
প্রতিটি অঙ্গরাজ্য নিজ নিজ স্বার্থে বিদেশের নিজ নিজ প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারবেন।
৬নং প্রস্তাবঃ আধা সামরিক বাহিনী গঠন
ছয় দফা দাবির সর্বশেষ প্রস্তাবটি ছিল আধা সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা অঙ্গরাজ্য গুলি কে দিতে হবে। যেমন পুলিস বা আনসার এর মত আধা সামরিক বাহিনী দুটি অঙ্গ রাজ্যে আলাদা আলাদা থাকবে।
এছাড়া বলা হয় যে, প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব একটি বাহিনী থাকবে। কেননা এই বাহিনীগুলো দিয়ে বেআইনি বিষয় ও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সহ সংসদীয় শাসনতন্ত্র রক্ষা করার কাজে ব্যবহার করা হবে।
শেষ কথা
বাঙালি হিসেবে আমাদের সবারই ঐতিহাসিক ছয় দফা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। আমরা যেমন বাঙালি তেমনি আমাদের ইতিহাস জানা খুবই প্রয়োজন। ব্রিটিশরা ২০০ বছর শাসন এবং পাকিস্তানের ২৩ থেকে ২৪ বছর শাসন ও শোষণের অনেক ইতিহাস এর পর এই দেশ স্বাধীন হয়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমাদের এই বঙ্গদেশে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। আমাদের বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশ সম্পর্কে পিছনের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে জানতে হয় এবং জানা খুব প্রয়োজন। অনেকেই ছয় দফা দাবি সম্পর্কে জানেন অনেকে হয়তো ছয় দফা দাবি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না।
আজকের এই গেলে আমরা ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবি কি কি উপায়ে দফা দাবি কেন করা হয়েছিল এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। হয়তো আমাদের আর্টিকেলটি পরে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে ও বুঝতে পেরেছেন।
আবার অনেকে হয়তো ছয় দফা দাবি ও ছয় দফা কেন করা হয়েছিল? এই সম্পর্কে কিছু টা বুঝতে পারেন নি। যারা বুঝতে পারেন নি, তারা কেন বুঝতে পারেন নি সেটা লিখে আমাদের কমেন্ট করে জানাতে পারেন।আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে আপনার সমস্যাটি সমাধান করে দেয়ার চেষ্টা করব।
আর আপনার কোন বন্ধু-বান্ধব কেউ যদি ছয় দফা সম্পর্কে কিছু জানতে আগ্রহী হয় তাহলে তার সাথে এই আর্টিকেলটি আপনি শেয়ার করতে পারেন। যাতে করে সে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি সমূহ সম্পর্কে জানতে পারে। দেখা হবে আবার নতুন কোন আর্টিকেলে নতুন কোন বিষয় নিয়ে। ততক্ষণ পর্যন্ত আশা করি সবাই ভাল থাকবেন সুস্থ থাকবেন।